‘আমাদের খবর নিয়া কি করবেন? কেউ কি আমাদের খবর রাখে? সরকার জমি দিছে কিন্তু আমাদের ঘর দেয় নাই। ঘরের জন্য ডিসি ও ইউএনও স্যারের কাছে গিয়ে ফিরে আসছি। দেখবো-দেখছি বলে শুধু সময়-মাস-বছর পার হচ্ছে, কেউ খবর নেয় না।’— এই কথাগুলো বলছিলেন বেদে ফাতেমা, জাহানা, আকলিমা ও সর্দার সাহেদ খান । দুই মাস মেঘনা নদীতে মাছ ধরা বন্ধ, তাই মাছ ধরতে না পেরে পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবন চলছে তাদের। আশ্রায়ণকেন্দ্রে বাবা-মায়ের কাছে এসে আশ্রয় নিয়ে জাল বুনে চলছে তাদের তিন বোনের পরিবার। চোখেমুখে কিছুটা চিন্তা আর আতঙ্কের ছাপ। জীবন-জীবিকার চিন্তায় যেন কারও মুখে হাসি নেই।

বেদে নারী আকলিমা খাতুন ও জাহানা বেগম বলেন, নদী আমাগো জীবন। এই নদীই আবার আমাগো সবার মরণ। নদীতে মাছ ধইরা যেমন খাবার জুটে, হেই নদীতেই আবার সন্তানদের মৃত্যু হয়। বহু চেষ্টা করি, তাদের সামলায়ে রাখতে। কিন্তু কখনও কখনও পানিতে ডুবে মইরা যায়। অনেক সময় তাদের লাশ খুঁজেও পাওয়া যায় না।

লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার দক্ষিণ চরবংশী ইউপির মেঘনা নদীসংলগ্ন স্লুইসগেট আশ্রায়ণকেন্দ্রে দেখা মেলে বানভাসি মানতা সম্প্রদায়ের।

দুঃসাহসী মানতা নারী ফাতেমা তার জীবন-সংগ্রাম আর কষ্টের গল্প তুলে ধরে বলেন, এক বছর আগে আমার একমাত্র সন্তান পানিতে পড়ে মারা যায়। সেই থেকে অনেক কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছি। কিন্তু তবু পানিতেই বাস করতে হবে। এত সতর্ক থেকেও বাঁচাতে পারিনি তাকে। জীবন-জীবিকার তাগিদে পানির ওপরে নৌকায় বসবাসকারী মানতা সম্প্রদায়ের দৈনন্দিন জীবন-জীবিকা ঠিক এমনই। নৌকার মাঝে সুখ-হাসি-আনন্দ খুঁজে পেলেও হারানোর বিয়োগ ব্যথায় কাঁদতেও হয় তাদের।

অবহেলিত-বঞ্চিত এসব মানুষ নদীতে সারা দিন জাল বুনে মাছ শিকার করেন। ওই মাছ স্থানীয় মাছ ঘাটে বিক্রি করে খাবারের ব্যবস্থা করেন। নৌকাতেই ঘর-সংসার তাদের, একমাত্র সহায়-সম্বলও। স্বাভাবিক জীবন থেকে আলাদা জীবনযুদ্ধে তাদের সঙ্গীও কেবল নৌকা আর জাল। নৌকায় বসবাস করতে গিয়ে কখনও কখনও তাদের হারাতে হয় ছোট ছোট শিশুসন্তানদের।

মানতা সর্দার মো. সাহেদ খান বলেন, কিছু দিন আগে দেলোয়ার ও মো. আলি খানের দুটি মেয়ে নৌকা থেকে পড়ে গিয়ে মারা যায়। এমন অনেক ঘটনা রয়েছে। গত এক বছরেই বহরের ১০ শিশু মারা গেছে। কঠিন জীবনযুদ্ধের মাঝেও সন্তানদের কথা মনে করে আজও কাঁদেন তারা।

মানতা সম্প্রদায়ের এ পরিবারের সদস্যরা জানান, মেঘনায় নৌকাতেই তাদের বসবাস। গোসল, রান্নাবান্না, বিয়ে, সন্তান লালনপালন, মাছ শিকারও চলে নৌকাতেই। কয়েক বছর আগে সরকার তাদের মেঘনার চরে সরকারি খাসজমি দিলেও বসতঘর দেয়নি।

নৌকাবহর নিয়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে তাদের ছুটতে হয়। কখনও কখনও ঝড়ের সঙ্গে লড়াই, আবার কখনও জলদস্যুদের কবলে পড়তে হয়। জীবনের নিরাপত্তা না থাকলেও নৌকাতেই চলে বসতি। প্রকৃতির বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে আবার নদীতে মাছ শিকারও করতে হয় তাদের। মাছ ধরা না পড়লে খেয়ে-না খেয়েও দিন কাটাতে হয়।

মানতা সর্দার সাহেদ খান বলেন, আমাদের ঘর-ভিটে নেই। নদীতেই বসবাস করি। সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা পাইনি। শিক্ষা ও চিকিৎসা থেকেও বঞ্চিত আমরা। গত বছরের ৬ অক্টোবর জেলা প্রশাসকের কাছে ৩৩ বেঁদে পরিবার সরকারিভাবে ঘর নির্মাণ ও পুনর্বাসন করার জন্য লিখিতভাবে আবেদন করলেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি বলেও জানান তিনি।

মানতা বধূ ফাতেমা ও খায়রুন নেছা জানান, ছোটবেলা থেকে নৌকাতেই বড় হয়েছেন তারা। পরে নৌকার বহরে বিয়ে হয়, সেই নৌকাতেই এখন সংসার জীবন তাদের। এখন সন্তানদের বড় করে তুলছেন তারা। একসময় তাদেরও বিয়ে দেওয়া হবে নৌকাতেই। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার ইচ্ছে রয়েছে তাদের। কিন্তু ফেরার কোনো উপায় নেই। নৌকায় জড়িয়ে রয়েছে তাদের জীবন-জীবিকা। এক সময় নৌকাতেই শেষ হবে জীবন।

রায়পুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অঞ্জন দাশ বলেন, মানতাদের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবায় আলাদা কোনো কর্মসূচি নেই। তবে প্রত্যন্ত এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ক্লিনিক কিংবা মেডিকেলে এলে সুবিধা নিতে পারবেন তারা। তারা এলে বা নজরে পড়লে আমরা অবশ্যই তাদের সহযোগিতা করব। বিভিন্ন এনজিও সংস্থাগুলোকেও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যেন তারা বঞ্চিত মানুষদের সহযোগিতা করে।
এ বিষয়ে ডিসির সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।

 

 

কলমকথা/ বিথী